আম এদেশে চাষযোগ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল। বর্তমানে দেশের ২২টি জেলায় বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয়েছে আমের চাষাবাদ। তবে জনপ্রিয় এই ফলটি দেশের সব জেলাতেই জন্মাতে ও ফলন দিতে পারে। বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবহার, পুষ্টিমান এবং স্বাদ- গন্ধে আম একটি অতুলনীয় ফল। জলবায়ুগত পরিবর্তনের ফলে আম বাগানে দেখা যাচ্ছে নতুন নতুন রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ। বর্তমান সময়ে আম বাগানে বালাইনাশকের ব্যবহার উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আম চাষি নিজের অজান্তে বিভিন্ন ধরনের বালাইনাশক বহুবার ব্যবহার করছেন। কীটনাশক স্প্রের বিষয়ে এখনই সচেতনতা সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে এটি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। আম বাগানে রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ অল্প থেকে শুরু করে ব্যাপকও হতে পারে। সঠিক সময়ে রোগ ও পোকামাকড় দমন করতে ব্যর্থ হলে আমের ফলন মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়। ছোট আকারের ফসলের ক্ষেত্রে অন্যান্য দমন পদ্ধতি যেমন-আক্রান্ত পাতা বা গাছের অংশ ছিঁড়ে ফেলা, পোকার ডিম বা কীড়া সংগ্রহ করে ধ্বংস করা, জাল দিয়ে পোকা সংগ্রহ করে নষ্ট করা সম্ভব কিন্তু আমের মতো বৃহৎ গাছে রোগ বা পোকামাকড় দমনের জন্য বালাইনাশক স্প্রে করা একান্ত জরুরি হয়ে পড়ে। আমের ফলন মূলত নির্ভর করে আম গাছে মুকুল বা পুষ্পমঞ্জুরির সংখ্যার ওপর। তাই আমের মুকুলে পোকা বা রোগের আক্রমণ হলে মুকুল বা ফুল নষ্ট হয়ে যেতে পারে ফলে ফলধারণ ব্যাহত হতে পারে। সুতরাং মুকুলে রোগ বা পোকার আক্রমণ দেখা দেয়া মাত্রই বালাইনাশকের স্প্রে করার বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।
স্প্রের মূলনীতি : যে কোনো
বালাইনাশক স্প্রে করতে ৪টি মূলনীতি অবশ্যই মেনে চলা উচিত। এগুলো হলো সঠিক
বালাইনাশক নির্বাচন, সঠিক ডোজ বা মাত্রা নির্ধারণ, সঠিক সময় নির্বাচন এবং
সঠিক পদ্ধতি
অনুসরণ।
সঠিক বালাইনাশক নির্বাচন : আমের রোগ বা ক্ষতিকর পোকা লাভজনকভাবে ও কম খরচে দমন করতে সঠিক ওষুধ নির্বাচন করা একটি অতীব গুরুত্বপূর্র্ণ পদক্ষেপ। ওষুধ নির্বাচনে কোনো ভুল হয়ে থাকলে স্প্রে কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে ভেস্তে যায়। এতে শ্রম, সময় ও অর্থের অপচয় ঘটে উপরন্ত আসল উদ্দেশ্য সম্পূর্ণভাবে ব্যাহত হয়। তখন কৃষক কীটনাশক ডিলারদের জিজ্ঞাসা করেন কি ওষুধ স্প্রে করতে হবে, এটা মোটেই ঠিক নয়। এ ব্যাপারে সঠিক পরামর্শের জন্য স্থানীয় কৃষিকর্মী, কৃষি অফিস বা আম গবেষণা কেন্দ্রে যোগাযোগ করা উচিত। একই গ্রুপের কীটনাশক বা ছত্রাকনাশক বার বার স্প্রে না করে মাঝে মাঝে পরিবর্তন করা উচিত কারণ একই ওষুধ বার বার স্প্রে করলে পোকা বা রোগের জীবাণুর প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যেতে পারে।
সঠিক মাত্রা নির্ধারণ :
সঠিক বালাইনাশক সঠিক মাত্রায় ব্যবহার করতে হবে। বালাইনাশকের মাত্রা কম বা
বেশি না হওয়াই উত্তম। উপযুক্ত মাত্রা না হলে রোগ বা পোকামাকড় ভালোভাবে দমন
করা সম্ভব হয় না। উপরন্ত রোগের জীবাণু বা পোকার মধ্যে বালাইনাশক প্রতিরোধ
ক্ষমতা বেড়ে যায়। আবার অধিক মাত্রায় বালাইনাশকের ব্যবহার অর্থের অপচয় হয়
এবং ফলগাছের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। তাই বালাইনাশকের
মাত্রার ব্যাপারে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। এজন্য বোতল বা প্যাকেটের গায়ে লিখিত
নির্দেশনা, কৃষি বিজ্ঞানীদের এবং কৃষিকর্মীর পরামর্শমতো কাজ করা উচিত।
সঠিক সময় নির্বাচন : কথায়
বলে, সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়। এ কথা সত্য যে কোনো কাজ সঠিক সময়ে
সমাধা করতে পারলে বাড়তি শ্রম ও বাড়তি খরচের অপচয় থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। আম
গাছে মুকুল আসার পর থেকে ফলধারণ পর্যন্ত সময়টুকু বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ে
রোগ বা পোকার আক্রমণ হলে গাফিলতি করা মোটেই ঠিক নয়। এ সময়ে উপযুক্ত পদক্ষেপ
গ্রহণে ব্যর্থ হলে আমগাছে ফলধারণ নাও হতে পারে। আম বাগানে মুকুল আসার
আনুমানিক ১০-১৫ দিন আগে আমগাছে প্রথম স্প্রে দিতে হবে। আমের মুকুল ১০-১২
সেমি. হলেই দ্বিতীয় স্প্রে দেয়া উচিত। মুকুলের ফুল ফোটার পর কোনো অবস্থাতেই
স্প্রে করা যাবে না। আমের পরাগায়ন প্রধানত বিভিন্ন প্রজাতির মাছির দ্বারা
হয়ে থাকে। তাই ফুল ফোটার সময় কীটনাশক স্প্রে করলে মাছি মারা যেতে পারে এবং
আমের পরাগায়ন ও ফলধারণ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে পারে। গাছ থেকে ফল পাড়ার
কমপক্ষে দুই সপ্তাহ আগে গাছে কোনো বালাইনাশক স্প্রে করা উচিত নয়। গাছে
মুকুল বের হওয়ার আগেই অর্থাৎ জানুয়ারি মাসে প্রয়োজনীয় অর্থ, শ্রমিক, স্প্রে
যন্ত্রপাতি, ওষুধ ইত্যাদি মজুদ রাখতে হবে।
সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ : সঠিক
ওষুধ, সঠিক মাত্রা, সঠিক সময় ইত্যাদি নির্ধারণের পর সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ
একান্ত প্রয়োজন। স্প্রে কার্যক্রম থেকে পরিপূর্ণ ফল লাভ করতে হলে অবশ্যই
সঠিক পদ্ধতিতে স্প্রে করতে হবে। ফলের মধ্যে বা ডালের মধ্যে ছিদ্রকারী পোকা
অবস্থান করলে বাইরে কীটনাশক স্প্রে করলে কোনো লাভ হয় না। আমের হপার পোকা
সুষ্ঠুভাবে দমন করতে হলে পাতায় স্প্রে করার সাথে সাথে গাছের গুঁড়িতেও
স্প্রে করা প্রয়োজন। তাই সুষ্ঠুভাবে রোগ বা পোকা দমনের জন্য স্থানীয় কৃষি
অফিস বা আম গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীদের সাথে আলাপ করে পরামর্শ নেওয়া
উচিত।
যে কোনো রোগ বা ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ দমন করার
সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে একটি জিনিস চিন্তা করা দরকার তা হলো রোগ বা পোকা দমন
করে কতটুকু লাভবান হওয়া যাবে। রোগ বা পোকার আক্রমণে যে পরিমাণ অর্থের ক্ষতি
করবে দমনের খরচ যদি তার চেয়ে বেশি হয় তবে সে রোগ বা পোকা দমনের জন্য
স্প্রে করা যুক্তিসঙ্গত হবে না। রোগ বা পোকার আক্রমণ কম হলে এবং তা
মারাত্মক হওয়ার সম্ভাবনা না থাকলে সে ক্ষেত্রে স্প্রে করা যুক্তিসঙ্গত নয়।
অহেতুক স্প্রে করলে অর্র্থ ও শ্রমের অপচয় হয়। তবে আমের মুকুলে
অ্যানথ্রাকনোজ বা পাউডারি মিলডিউ রোগের আক্রমণ দেখা না গেলেও আবহাওয়া যদি
রোগের আক্রমণের জন্য অনুকূল হয় তবে প্রতিষেধক ব্যবস্থা হিসাবে ছত্রাকনাশক
স্প্রে করতে হবে। অনুরূপভাবে আমের মুকুলে হপার বা শোষক পোকার উপস্থিতি কম
হলেও প্রতিষেধক ব্যবস্থা হিসাবে কীটনাশক স্প্রে করতে হবে। কেননা এ পোকা
অনুকূল আবহাওয়ায় অতি অল্প সময়ে অনেক বংশ বৃদ্ধি করতে ও মারাত্মক ক্ষতি করতে
সক্ষম।
সতর্কতা : কীটনাশক বা
ছত্রাকনাশক মাত্রই বিষ। তাই এদের ব্যবহারে সব সময় সতর্কতা অবলম্বন করা
প্রয়োজন। সতর্কতা অবলম্বনে কোনো প্রকার গাফিলতি দেখালে যে কোনো সময়
দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তাই কীটনাশক ডিলার ভাইদের উচিত কীটনাশক বা
ছত্রাকনাশক বিক্রির সময় সেগুলো ব্যবহারে কী কী সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে তা
আমচাষি ভাইদের স্মরণ করে দেয়া। যে কোনো বালাইনাশক স্প্রে করার সময়
নিম্নলিখিত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে-
কোনো বালাইনাশক সরাসরি হাত দিয়ে স্পর্শ করা
উচিত নয়। প্রয়োজনে হাতে গ্লাবস ব্যবহার করতে হবে। যিনি বালাইনাশক স্প্রে
করবেন তার সমস্ত শরীর ঢেকে রাখার জন্য এপ্রোন পরিধান করতে হবে। চোখে চশমা ও
মাথায় ক্যাপ বা হেলমেট পরতে হবে। পায়ে জুতা থাকা ভালো।
কোনো বালাইনাশক মুখে দেয়া বা গন্ধ নেয়া যাবে
না। স্প্রেকালীন কোনো প্রকার খাওয়া-দাওয়া বা ধূমপান করা যাবে না। স্প্রে
সময়ে পুকুর বা অন্য কোনো পানির উৎস যাতে দূষিত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে
হবে। স্প্রে শেষ হলে শরীর ও জামাকাপড় সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে।
খাদ্যদ্রব্য ও পশুখাদ্য স্প্রে এলাকা থেকে দূরে রাখতে হবে। স্প্রে করার ২
দিনের মধ্যে গাছের নিচে গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি ইত্যাদি চরতে দেয়া অনুচিত
কারণ তারা ঘাস বা মৃত পোকামাকড় খেয়ে বিপদে পড়তে পারে। বাতাসের অনুকূলে
স্প্রে করতে হবে অর্থাৎ পূর্ব দিক থেকে বাতাস পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হলে
গাছের পূর্ব দিকে দাঁড়ায়ে স্প্রে করতে হবে। বালাইনাশকের খালি প্যাকেট বা
বোতল অন্য কোনো কাজে ব্যবহার না করে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে।
ব্যবহারের পর স্প্রে যন্ত্রপাতি পরিষ্কার করে রাখতে হবে।
স্প্রে করার ১৫-২০ দিনের মধ্যে গাছের আম খাওয়া যাবেনা তাই আম পাড়ার ১৫-২০
দিন আগেই আম গাছে স্প্রে বন্ধ করতে হবে। সব বালাইনাশক শুষ্ক ও ঠাণ্ডা
জায়গায় তালাবদ্ধ অবস্থায় এবং শিশুদের নাগালের বাইরে সংরক্ষণ করতে হবে।
আম বাগানের রোগ ও পোকামাকড় ব্যবস্থাপনায়
প্রতিষেধকের চেয়ে প্রতিরোধক ব্যবস্থায় বেশি কার্যকরী। উল্লিখিত বিষয়গুলোর
ওপর নজর দিলে খুব সহজেই এবং কম খরচে আম বাগানের রোগ-পোকামাকড় দমন করে ভালো
ফলন পাওয়া সম্ভব হবে। পরিশেষে আমচাষির জন্য একটি পরামর্শ হলো সম্ভব হলে একই
এলাকার সব আম বাগানে একই সময়ে স্প্রে করা, এটি পোকামাকড় দমনে খুবই কার্যকর
ও ফলপ্রসূ।
* ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, চাঁপাইনবাবগঞ্জ
উত্তর সমূহ